⭕ রান্নার জন্য কোন তেলটি সবচেয়ে ভালো??
বাজার থেকে রান্নার জন্য তেল নির্বাচন করতে গিয়ে আমার সবসময়ই দোটানায় পরে যাই, কারন তেলগুলোর প্যাকেজিং আর বিজ্ঞাপনে সব তেলকেই সেরা বলে দাবি করা হয়। এর মাঝে যেকোনো একটাকে বেছে নেওয়া অনেক সময়ই কঠিন। তাহলে আসুন জেনে নিই কোন তেলটি সবচেয়ে সেরা।
✅খাবার তেল ও চর্বি মূলত একই ধরনের পদার্থ। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় যা তরল থাকে, তাকে বলা হয় তেল, আর যা অর্ধ জমাট বা জমাট থাকে, তাকে বলা হয় চর্বি। এসব তেল বা চর্বি সম্পৃক্ত বা স্যাচুরেটেড(SFA), একক অসম্পৃক্ত বা মনো আনস্যাচুরেটেড(MUFA) এবং বহু অম্পৃক্ত বা পলি আনস্যাচুরেটেড(PUFA) ফ্যাটি অ্যাসিডের যৌগ। তবে প্রাণিজ তেলে কোলেস্টেরল থাকলেও উদ্ভিজ্জ তেলে থাকে না।
থাকলেও খুবই কম পরিমাণ। এ কারণে কিছুদিন আগেও মনে করা হতো উদ্ভিজ্জ ভোজ্য তেল স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, কিন্তু প্রাণিজ তেল ক্ষতিকর।
তবে নতুন কিছু গবেষণা থেকে পাওয়া যায় যে, যে তেলের স্মোকিং পয়েন্ট যত কম সেই তেল বেশি তাপমাত্রায় রান্নায় ক্ষতি তত বেশি। আবার ভাজা বা রান্নার জন্য বেশি তাপমাত্রা (১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা কাছাকাছি তাপমাত্রায়) ব্যবহার করলে, তেলের স্বাভাবিক কাঠামো পরিবর্তিত হয়ে অ্যালডিহাইড এবং লিপিড পার অক্সাইড গঠিত হয়। লিপিড পচে যাওয়ার সময়ও অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে এই যৌগ উৎপন্ন হয়।
যেকোনো অ্যালডিহাইড খুব সামান্য পরিমাণে খেয়ে ফেললে বা নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করলে, তা ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। হৃদরোগ বা ক্যানসারের মতো রোগও হতে পারে অ্যালিডিহাইড থেকে।
অধ্যাপক মার্টিন গ্রুটভেল্ড বলেন, ‘ভুট্টা বা সূর্যমুখী বা সয়াবিন তেলের মতো যেসব তেলে বহু-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের (PUFA) পরিমাণ বেশি, সেগুলো উচ্চমাত্রার অ্যালডিহাইড তৈরি করে।’
অপরদিকে, অলিভ বা ক্যানোলা তেল খুব সামান্য অ্যালডিহাইড উৎপাদন করে। মাখন ও হাঁসের চর্বির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এর কারণ হলো এসব তেলে সম্পৃক্ত(SFA) ও একক-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের (MUFA) পরিমাণ থাকে বেশি। উচ্চ তাপমাত্রাতেও এগুলোতে তেমন কোনো রাসায়নিক পরিবর্তন হয় না।
✅তেল বা চর্বি নিয়ে কথা বলতে গেলে ওমেগা ফ্যাটি এসিডের কথা না বললে আলোচনা অসমাপ্ত থেকে যায়।
ওমেগা-৬ আর ওমেগা-৩ এই দু’ধরণের ফ্যাটি এসিড আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজন। ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড
পাওয়া যায় সাধারণ উদ্দিজ্জ তেলগুলোতে যেমন সয়াবিন, কর্ন, সানফ্লাওয়ার, ক্যানোলা, কটনসীড, পাম ইত্যাদি
তেলে। আর ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায় ম্যাকারেল, এনচাভি, হেরিং, স্যালমন, ইলিশ প্রভৃতি সামুদ্রিক মাছে
এবং সবুজ শাক-সব্জি, সয়াবিন তেল, ক্যানোলা তেল, চিয়াসীড, ফ্ল্যাক্সসীড, হেম্পসীড, আখরোট ইত্যাদিতে।
ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ উভয় ফ্যাটি এসিডই শরীরের বৃদ্ধিতে ও গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে এদের যদি সঠিক অনুপাতে না খাওয়া হয় তাহলেও হতে পারে নানান স্বাস্থ্য সমস্যা।
⭕ কাজেই শুধু একটি তেল নির্বাচন করলেই সকল সমস্যার সমাধান মিলবে না। আসুন দেখি কোন তেলটি আমরা কোন কোন কাজে ব্যবহার করলে সর্বোচ্চ উপকার পাবো এবং ক্ষতি এরিয়ে চলতে পারবোঃ
✅ অলিভ তেল
ভোজ্য তেল হিসেবে অলিভ ওয়েল বা extra virgin অলিভ অয়েল পৃথিবী জুড়ে বিখ্যাত। সাধারণত অলিভ অয়েলে সবচেয়ে বেশি MUFA থাকে, আর extra virgin তেলটি উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না যেমন ভাজা বা স্যতে করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো। তাছাড়া extra virgin অলিভ অয়েল সালাদ ড্রেসিং এর জন্যও অনেক ভালো কারণ এটি যেমন লাইট তেমনই এই তেল খাবারে ফ্লেভার যোগ করে এবং এটি এন্টি এক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ।
তবে এতে ওমেগা ৩ থাকে না।
✅ সরিষার তেল
ঘানি ভাংগা সরিষার তেল প্রাচীন কাল থেকেই আমাদের দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে রান্নায়, যার পুষ্টিগুন অন্যান্য অনেক তেলের তূলনায় ভালো, কেনোন এই তেলে ৬০% MUFA আর ওমেগা ফ্যাটি এসিডও সুষম অনুপাতে থাকে। যার ফলে কোনো কোনো বিজ্ঞানী সরিষার তেলকে হার্টের রোগীর জন্য উত্তম বলে দ্বাবি করেন।
তবে সরিষার তেলে ইউরিক এসিড বৃদ্ধি পাওয়ার ঝুঁকি থাকায় অনেক চিকিৎসকই বেশি মাত্রায় এই তেল গ্রহন করতে নিষেধ করেন।
✅ ক্যনোলা তেল
Rapeseeds বা রাই সরিষার দানা থেকে উৎপন্ন এই তেলে ৬২% MUFA ও ওমেগা ফ্যাটস আছে। ক্যানোলা তেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাট সবচেয়ে কম থাকে, আবার এই তেলে ইউরিক এসিডের সমস্যাও হয় না। ক্যনোলা তেল হার্টের রোগীর জন্য সবচেয়ে ভালো। তাই রান্নার জন্য এই তেল সারা পৃথিবীতে এখন সমাদৃত।
✅ সয়াবিন তেল
সয়াবিন তেল আমাদের দেশে ব্যাপক হারে বিক্রি হচ্ছে কারন এতে স্যাচুরেটেড ফ্যাট খুব কম থাকে, দামে সস্তা, উৎপাদন প্রক্রিয়া সহজ, এছাড়া এই তেলে ওমেগা ৩ পাওয়া যায় এবং আধুনিক কালে এতে ভিটামিন-এ, ডি যোগ করা হয়। এজন্য এই তেলটিকে হার্ট হেলদি বলা হয়।
তবে সয়বিন তেলে PUFA বেশি থাকায় এই তেল মাত্র ২০-৩০ মিনিট ১৮০° সেঃ এ রান্না করা হলে বা ভাজা হলেই স্মোক তৈরি হয়ে যায় যার ফলে খুব দ্রুত ট্রান্সফ্যাট, এলডিহাইডের মত ক্ষতিকারক যৌগ উৎপন্ন হয়। আবার আমরা একই খাবার ২/৩ বার জ্বাল দিয়ে খাই বলে এই তেলে রান্না খাবারে হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
তাই সয়াবিন তেল রান্না নয় বরং স্যতে বা সালাদ ড্রেসিং হিসেবে বেশি ভালো।
✅ রাইস ব্রান তেল
১০০% প্রাকৃতিক ও কোলেস্টেরল মুক্ত, এতে প্রচুর ভিটামিন ই ও এন্টিঅক্সিডেন্ট আছে যা ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। তবে এতে PUFA ও MUFA প্রায় সমান অনুপাতে থাকে এবং এতে ওমেগা ৩ থাকে নাই বললেই চলে, তবে এই তেলের স্মোক পয়েন্ট হাই হওয়ায় উচ্চ তাপে এই তেল ব্যবহার করা যায়।
তবে কেনার সময় অবস্যই ভালো মানের রাইস ব্রান তেলটি নির্বাচন করতে হবে।
✅ সান ফ্লাওয়ার তেল
সূর্যমুখী তেল ইদানিং খুবই আলোচিত একটি তেল। এই তেলের স্মোক পয়েন্ট বেশি হওয়ায় অনেকে একে ক্যনোলা তেলের মতো বলে দাবি করেন। তবে সান ফ্লাওয়ার তেলে অন্যান্য সব তেলের চেয়ে বেশি মাত্রায় PUFA থাকায় এবং উচ্চ ওলেয়িক হওয়ায় এই তেল থেকে সহজে ট্রান্স ফ্যাট হওয়ার ঝুকি বেশি থাকে। তবে এই তেল স্যতে ও সালাদ ড্রেসিং হিসেবে উত্তম।
✅ তিলের তেল ও বাদাম তেল
তিলের তেল বা বাদামের তেলে প্রায় সম পরিমান PUFA ও MUFA থাকে। এদের স্মোক পয়েন্টও বেশি হওয়ায় এই তেলে রান্না স্বাস্থ্যকর। সাধারনত সবজির স্টির ফ্রাই করতে এই দুই তেল ব্যবহৃত হয়। তবে কড়া ফ্লেভারের কারনে অনেকেই এই তেল পছন্দ করে না। তবে সালাদ ড্রেসিং হিসেবে এদের জুরি নেই।
✅ নারিকেল তেল
রান্নায় অনেকেই নারিকেল তেল ব্যবহার করেন। এতে ৯২% স্যচুরেটেড ফ্যাট থাকায় অনেক চিকিৎসকই এই তেলে রান্না নিষেধ করেন। তবে নতুন কিছু গবেষণায় এই তেলের হলো ইফেক্টের জন্য হার্ট ফ্রেন্ডলি বলে দাবি করেন। তবে LDL cholesterol বাড়ায় বলে দাবি করেন আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশন, যা কিনা হৃদরোগের অন্যতম কারন।
তবে সহজে হজম হয় এবং PUFA কম বলে ও স্মোক পয়েন্ট উচ্চ হওয়ায় এই তেল দিয়ে বেকিং বা ভাজা সুবিধাজনক।
✅ বাটার
বাটার হলো প্রানিজ ফ্যাট যা প্রাকৃতিক একটি ডেইরি পন্য। এতে স্যচুরেটেড ফ্যাট থাকে, ডেইরি পন্য হওয়ায় এতে ভিটামিন এ, ডি, ই, সেলেনিয়াম, আয়রন, লেসিথিন ও অত্যাবশকীয় ফ্যটি এসিড থাকে যা শিশুদের ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট এ অনেক উপকারী। এছাড়া এর স্মোকিং পয়েন্ট অনেক বেশি আর PUFA না থাকায় এটি উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করা যায়। তাই বাটার বেকিং এ সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।
✅ ঘি
ঘি অতি প্রাচীন কাল থেকে আমাদের দেশে রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, এতে স্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি থাকলেও PUFA না থাকায় ঘি দিয়ে যেকোনো কিছু উচ্চ তাপে ভাজা বা রান্না করা যায়। এছাড়া ঘি তে ওমেগা ৩, ভিটামিন এ, ডি, ই, কে থাকায় ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট এ ঘি অনেক কার্যকর। তাছাড়া পেটের পীড়ায়ও ঘি ভালো উপকারী। তবে ল্যাক্টোস এবং কেসিন ফ্রি হওয়ায় বাটারের চেয়ে ঘি কেই বেশি উপকারী বলে দাবি করেন অনেকে।
⭕ আসলে যে কোনো একটি তেলে সবরকম রান্না করে ফেলাটা ক্ষতিকর, তাই তেল নির্বাচনের সময় খেয়াল রাখতে হবে কোন তেল বা চর্বিটি দিয়ে কোন রান্না করা হবে। এছাড়া বিভিন্ন উৎসের তেল ব্যবহার করা হলে সহজেই সব কয়টি প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিড পাওয়া যাবে।
আর মনে রাখতে হবে যে, যে কোনো কিছুই অতিরিক্ত গ্রহন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তাই অতিরিক্ত তেলে ভাজা, কিংবা উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না খাবার পরিহার করতে হবে ও বার বার গরম করে খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
0 Comments