#ইউরিক এসিড


#ইউরিক এসিড

ঘুম ভেঙ্গে অথবা দীর্ঘক্ষণ একভাবে থাকার পর অবস্থান পরিবর্তনের সময় লক্ষ্য করলেন, বিভিন্ন জয়েন্টে ভীষণ ব্যথা, পা ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। এমন সমস্যা তখনই শুরু হয় যখন শরীরে ইউরিক এসিডের মাত্রা বেড়ে যায়। 
👉রক্তে ইউরিক এসিডের স্বাভাবিক মাত্রা পুরুষদের ক্ষেত্রে ৩.০-৭.০ মি.গ্রা./ ডি.এল এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ২.৪-৫.৭ মি.গ্রা./ডি.এল।

👉রক্তে ইউরিক এসিড বেড়ে গেলে তাকে হাইপার ইউরেসিমিয়া বলে। ইউরিক এসিডের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আমাদের দেহে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়, বাকিটা আসে আমাদের খাদ্য থেকে, বিশেষ করে পিউরিন সমৃদ্ধ খাবার থেকে। কেননা, পিউরিন ভেঙে ইউরিক এসিড তৈরি হয়।

আমাদের শরীরে স্বাভাবিকভাবেই একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে ইউরিক এসিড থাকে। কিন্তু ঝামেলা বাঁধে যখন কিডনি অতিরিক্ত ইউরিক এসিড শরীর থেকে বের করে দিতে পারে না কিংবা দেহ অতিরিক্ত ইউরিক এসিড তৈরি করতে শুরু করে। তখন এই অতিরিক্ত ইউরিক এসিড ক্রিস্টাল আকারে দেহের বিভিন্ন অস্থিসন্ধি বা জয়েন্টে জমতে থাকে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে মাঝারি থেকে তীব্র ব্যথা, ফুলে যাওয়া, লাল হওয়া এবং যন্ত্রণা অনুভব করে থাকেন।

অনেকের ইউরিক এসিড বেড়ে গেলে মেডিসিন গ্রহণ করার পরও ব্যথা বা যন্ত্রণার  তীব্রতা কমে না। এর কারণ হল- ইউরিক এসিড কমানোর জন্য মেডিসিনের পাশাপাশি সঠিক খাদ্য গ্রহণ করা হয় না।

👉👉যেসব খাবার খেলে ইউরিক এসিড বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে অর্থাৎ পিউরিন সমৃদ্ধ খাবার খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে এবং যেসব খাবার অতিরিক্ত ইউরিক এসিড কমাতে সাহায্য করে সেসব খাবার খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে আপনার ওজন।

তবে শুরুতে জেনে নিন ইউরিক এসিড কমাতে যে খাবারগুলো খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেবেন।   
 
👉যে খাবারগুলো বাদ দেবেন

#রেড মিট
গরুর মাংস, খাসির মাংস, ভেড়ার মাংস, মহিষের মাংস। যেসব খাবার খেলে ইউরিক এসিড বেড়ে যায় রেড মিট বা লাল মাংস তাদের অন্যতম।

এছাড়া সাদা মাংস, যেমন- মুরগীর মাংসেও ইউরিক এসিড বেশি থাকে তবে লাল মাংসের তুলনায় কিছুটা কম। তাই যাদের ইউরিক এসিড বেশি তারা লাল মাংস একদম পরিহার করুন এবং সাদা মাংস পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করুন।

#অর্গান মিট
মগজ, কলিজা, জিহবা, কিডনি। লাল এবং সাদা মাংসের মতো অর্গান মিটে ইউরিক এসিদের পরিমাণ অনেক বেশি। তাই এগুলো আপনার যতই প্রিয় হোক না কেন আপনার দেহের ইউরিক এসিডের মাত্রা ঠিক রাখতে আপনার খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিন এই খাবারগুলো। 

#পাখির মাংস
হাঁস, কবুতর, কোয়েল পাখি বা অন্য যেকোনো পাখির মাংস। যদি ইউরিক এসিড কমাতে চান তবে খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে এসব উচ্চ পিউরিন সমৃদ্ধ খাবার।

#পিচ্ছিল সব্জি
ঢ্যাঁড়স, কচুর লতি, কচুর মুখী, পুঁইশাক প্রভৃতি সব্জি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হলেও ইউরিক এসিডের লেভেল ঠিক রাখতে এই সব্জিগুলো বাদ দিতে হবে।

এছাড়া ফুলকপি, মাশরুম, পালংশাক, শিম, মটরশুঁটি, বেগুন খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে অথবা খুবই সীমিত পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে, যতদিন না পর্যন্ত ইউরিক এসিডের মাত্রা স্বাভাবিক না হয়।     

ইস্ট দিয়ে তৈরি খাবার এবং ইস্ট সাপ্লিমেন্ট
যেসব খাবার তৈরিতে ইস্ট ব্যবহার করা হয় যেমন- পাউরুটি, নান, বিয়ার প্রভৃতি ইউরিক এসিড নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে অবশ্যই খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে।
সব ধরনের ডাল এবং ডালের তৈরি খাবার পিয়াজু, বেগুনি, ফুচকা, চটপটি, খিচুরি- এসব খাবার মুখরোচক হলেও ইউরিক এসিড কমাতে হলে লাগাম দিতে হবে এসব খাবারে। 

বাদাম, বীচি জাতীয় খাবার
শিমের বীচি, কাঁঠালের বীচি, বিভিন্ন ধরনের বাদাম বাদ দিন যদি ইউরিক এসিডের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে চান। 

সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, মাছের ডিম
যেকোনো ধরনের মাছ, সেটা সামুদ্রিক মাছ হোক আর মিঠা পানির মাছ হোক- এতে পিউরিনের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। তাই এই সামুদ্রিক মাছ, শামুক, ঝিনুক, চিংড়ি, কাঁকড়া, মাছের ডিম- এসব খাবার ইউরিক এসিড নিয়ন্ত্রণে বাদ দেয়া উচিত।

সুগারি ফুড এবং বেভারেজ
অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার যেমন- কেক, মিষ্টি, ফলের রস, পেপসি, কোক প্রভৃতির কারণে ইউরিক এসিড বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে বাদ দিন এই ধরনের খাবারগুলো। 

হাই ফ্রুক্টোজ বা অতিরিক্ত মিষ্টি ফল এবং খাবার
যেসব ফলে বা খাবারে ফ্রুক্টোজ বেশি থাকে সেসব খাবার ইউরিক এসিড কমার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। তাই, ফলের মধ্যে খেজুর, আতাফল, বেদানা, কাঁঠাল, আঙুর, নাশপাতি, পীচ, আম, তাল, চেরী, কিউই ফল, আলুবোখারা পাশাপাশি মধু, গুড় এবং গুড়ের তৈরি খাবার খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে।

👉 এক নজরে দেখে নেয়া যাক  যে খাবারে ইউরিক এসিড বেশি থাকে

* সামুদ্রিক মাছ, গরু ও খাসির মাংস, হাঁস বা ভেড়ার মাংস, কলিজা, মগজ, 
ফুসফুস,গুর্দা, মাশরুম, মুরগির চামড়া, চিংড়ি, কাঁকড়া, শুঁটকি, ইলিশ মাছ, মাংসের স্যুপ, পায়া, মাছের কাঁটা, মাছের ডিম।

* মসুর ডাল, মাষকলাই ডাল, মটর, চিনাবাদাম, কাঠবাদাম, তিল, সিমের বীচি।

* পুঁই শাক, পালং শাক, মুলা শাক, পাট শাক।

* মুলা, ঢ়েঁড়স, মিষ্টি কুমড়া, বীচি জাতীয় খাবার, মিষ্টি আলু, ওলকপি, বিট, টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, সজনে, সিম, বরবটি, কাঁঠালের বীচি, সিমের বীচি, বেগুন।

* সব ডাল, বাদাম ও বাদাম জাতীয় খাদ্য, লবণ যুক্ত খাদ্য, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত ও তেলে ভাজা খাবার, হাঁসের ডিম, কফি, আচার, ইস্ট বা ইস্টের তৈরি যে কোনো খাবার, পনির।

👉ইউরিক এসিড কমাতে যা খাবেন

#সঠিক পরিমাণে পানি
বিশুদ্ধ পানি যেমন করে শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেয়, একইভাবে সঠিক পরিমাণে পানি পান করলে অতিরিক্ত ইউরিক এসিড শরীর থেকে বের হয়ে যায়। সুতারং, প্রতিদিন অন্তত ১০-১২ গ্লাস পানি পান করুন।

#ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার
ইউরিক এসিডের মাত্রা কমাতে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবারের জুড়ি নেই। তাই নিয়মিত খাদ্য তালিকায় রাখুন গোটা শস্য, শাকসবজি এবং ফলমূল, ওটস, ইসবগুলের ভুষি।

ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড মেডিক্যাল সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, নিয়মিত ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করলে ইউরিক এসিডের মাত্রা কমে।

মূলত ডায়াটেরি ফাইবার ব্লাডস্ট্রিমে থাকা অতিরিক্ত ইউরিক এসিড দেহ থেকে বের করে দিতে সাহায্য করে।

#ভিটামিন সি
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রতিদিন ৫০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি গ্রহণ করলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইউরিক এসিডের লেভেল কমে যায়। ভিটামিন সি অতিরিক্ত ইউরিক এসিড ইউরিনের মাধ্যমে বের করে দেয়। সুতরাং, ইউরিক এসিড কমাতে লেবু, আমলকী, আমড়া, পেয়ারা, কমলা খান নিয়মিত।

#আনারস
ইউরিক এসিড কমাতে আনারস খুবই কার্যকর একটি ফল। মানবদেহের জন্য প্রতিদিন যে পরিমাণ ভিটামিন সি দরকার হয় এর ১০০%-ই ১ কাপ আনারস খেলে পূরণ হবে। অন্যান্য ফলের তুলনায় আনারসে ফ্রুক্টোজের পরিমাণ অনেক কম। তাই বাড়তি চিন্তার কারণ নেই।

এছাড়া আনারসে রয়েছে ব্রোলামিন নামক এনজাইম যা প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। সুতরাং, যারা ইউরিক এসিড কমাতে চান তারা প্রতিদিন কিছুটা হলেও আনারস খান।

লো ফ্যাট মিল্ক, টক দই এবং ডিম
হাইপার ইউরেসেমিয়া কমাতে এবং সেই সঙ্গে প্রোটিনের চাহিদা পূরণের জন্য বেছে নিন লো ফ্যাট মিল্ক, লো ফ্যাট দই এবং কুসুম ছাড়া ডিম।

#অলিভ অয়েল    
আপনার রান্নায় পরিমিত তেল ব্যবহার করুন। আর রান্নায় ব্যবহার করুন অলিভ অয়েল। অলিভ অয়েলে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে রয়েছে প্রদাহবিরোধী উপাদান। যা অতিরিক্ত ইউরিক এসিডের কারণে সৃষ্ট জয়েন্টের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। 

#আপেল
আপেলে থাকা ম্যালিক এসিড ইউরিক এসিড নিউট্রালাইজড করতে সাহায্য করে। তবে আপেলে ফ্রুক্টোজের পরিমাণ বেশি থাকায় খুব বড় সাইজের নয়, প্রতিদিন খাবার পর ছোট একটি আপেল রাখুন আপনার খাদ্য তালিকায়।

#প্রোটিন- যেহেতু এ সব রোগীদের ক্ষেত্রে প্রোটিন জাতীয় খাবার বর্জন করার পরামর্শ দেয়া হয় তাই সারা দিনের প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে মিঠা পানির মাছ ও চামড়া ছাড়া মুরগী, ডিমের সাদা অংশ, টক দই, দুধ গ্রহণ করা যেতে পারে।

#শাক- লাল শাক, ডাটা শাক, সরিষা শাক, লাউ শাক।
# সবজি- কাঁকরোল, পেঁপে, ধুন্দল, চিচিঙ্গা, পটল, করলা (অবশ্যই বীচি ছাড়া)।

#ফল- সবুজ আপেল, নাশপাতি, পাকা পেঁপে, বীচি ছাড়া পেয়ারা, বীচি ছাড়া পাকা বেল।

* অন্যান্য- চাল, আটা, ময়দা, সুজি, ভুট্টা, সেমাই, চিড়া, মুড়ি, কর্নফ্লেক্স, সাবুদানা, মুগ ডাল (অল্প পরিমাণে)।

সুতরাং, যারা ইউরিক এসিড কমাতে চান মেডিসিনের পাশাপাশি উপরের নির্দেশিকা মেনে চলুন এবং সুস্থ থাকুন সহজেই। 

💞💞সঠিক ডায়েটের পাশাপাশি ‘থেরাপিউটিক ফুড’ ইউরিক এসিডকে কমিয়ে দিতে ভালো কাজ করে

* ১ গ্লাস লাউয়ের জুস, ১ চামচ মৌরির গুঁড়া, ২/৩টি গোল মরিচের গুঁড়া ভালোভাবে মিক্স করে সকালবেলার নাশতার সময় খেতে পারেন। উপকারিতা- এতে ভিটামিন ‘বি’ ও ‘সি’ আছে, যা ডিটক্সিফিকেশন হিসেবে কাজ করে বডির ইউরিক এসিডকে কমিয়ে দেয়।

* ২০০ মিলি পানির সঙ্গে ২ চা চামচ মেথি রাতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। সকালে পানি ছেঁকে নিয়ে মেথিগুলো পেস্ট বানিয়ে সেই ২০০ মিলি পানির সঙ্গে জ্বাল করে ফুটাতে হবে। এই পানীয় সকালের নাশতা খাবার ১০-১৫ মিনিট আগে খেতে হবে। উপকারিতা- আয়রন খুব বেশি থাকে এবং ব্যথা দূর করে।

* ১ চামচ মধুর সঙ্গে ১ চামচ কালো জিরার তেল মিক্সড করে ১০-১৫ দিন খেতে পারেন। উপকারিতা- ব্যথা দূর করতে বেশ কার্যকারী।

* দৈনিক কাঁচা রসুন খেতে পারেন ৫/৬টি কোয়া। উপকারিতা- ব্যথা দূর করতে কার্যকারী।

👉সঠিক ডায়েটের মাধ্যমে ইউরিক এসিডের মাত্রা কমে গেলে ২ মাস পর আবার রক্তের ইউরিক এসিডের মাত্রা পরীক্ষা করুন।
👉 ইউরিক এসিডের মাত্রা স্বাভাবিক হলেও সহসাই আবার বাদকৃত খাবারগুলাকে খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না, ধীরে ধীরে বিশেষজ্ঞের পরামর্শে স্বাভাবিক খাদ্য তালিকায় ফিরে যেতে হবে। 👉রক্তে ইউরিক এসিড বেড়ে গেলে অবশ্যই সঠিক ডায়েট ঠিক করে ফেলুন যা খুব সহজেই ব্যথামুক্ত এবং অতিশিগগির সুস্থ করে তুলতে সাহায্য করবে।

Post a Comment

0 Comments